এপিডেমিক এবং প্যান্ডেমিক, বাংলা অভিধানে দুটো শব্দের অর্থই মহামারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই দুটি অবস্থাকে তেমন সুস্পষ্ট ভাবে আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করেনি। এপিডেমিকের বিস্তার ব্যাপক হলেই তাকে প্যান্ডেমিক বলা হচ্ছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ এর প্রকোপকে গ্লোবাল প্যান্ডেমিক ঘোষণা দেওয়া থেকে বলতে পারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকরা এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের আশংকা করছেন। এর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত প্রভাবের কথা যদি ছেড়েও দেই, একটা দৃশ্য কিছুতেই চোখের সামনে থেকে সরাতে পারিনা। সেটা হলো লাশের মিছিল। ১৩৪৭ সালে এশিয়া এবং ইউরোপে যে প্লেগ হয়েছিলো তাতে প্রায় ২০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সেই সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি আজকের মতো ছিলোনা। মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়েছে মানুষ। আজ প্রযুক্তির অনেকটা স্বর্ণযুগ বলা চলে। কিন্তু তাতেই কি শেষ রক্ষা হচ্ছে? ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রাণ হারায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। সেই সময়ে কলেরা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায় আরো প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। তারও পরে ১৯৮১ সাল থেকে আজ অবধি এইচআইভি তে প্রাণ হারিয়েছে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কোটি মানুষ। মাত্র এক দশক আগে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে প্রাণ হারায় দুই লক্ষ মানুষ। ২০১৪ সালে ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ। এ তো কেবল বাছাই করা কিছু পরিসংখ্যান। ইতিহাস এমন আরো অনেক মহামারী এবং অসংখ্য মৃত্যুর সাক্ষী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালের শেষ থেকে ২০২০ এর মার্চ অবধি কোভিড-১৯ এ মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যদি বিশ্বব্যাপী এতটা সতর্কতা অবলম্বন করা না হতো তাহলে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর সংখ্যা চার কোটি পর্যন্ত হতে পারতো। বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং, ট্রাভেল ব্যান, জরুরি অবস্থা, লকডাউন, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে গবেষণায় অগ্রগতি সহ ব্যাপক ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিতে মৃত্যুর হার প্রতি দশ লক্ষে প্রতি সপ্তাহে যদি ২ জন হয়, তাহলে মৃত্যুর মোট সংখ্যা ১৮ থেকে ২০ লক্ষের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে। ১৮ লক্ষ লাশের মিছিল আমার চোখে অনেক দীর্ঘ। প্রানপনে প্রার্থনা করি এ মিছিল যেন এতটা দীর্ঘ না হয়।
মৃত্যুরও একটা সৌন্দর্য্য আছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সেসময় যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে, যেন একটি করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে জীবনের অন্ত হয়। কিন্তু মহামারীর মৃত্যুতে এই সৌন্দর্যটুকু আর থাকেনা। সংক্রামণের ভয়ে জীবিত অবস্থায় যেমন রোগীকে কাছের জনদের স্নেহকরস্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, মৃত্যুর পর মৃতদেহ নিয়েও দেখা দেয় বিপত্তি। কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের সেই দুঃসময়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইরাকের একজন সাদ মালিক পিতার লাশ নিয়ে সাতদিন যাবৎ ঘুরে ফিরছে গোরস্থান থেকে গোরস্থানে, কিন্তু জায়গা পাচ্ছে না। বাংলাদেশের নাটোরে একজন অজানা ব্যক্তির লাশ পরে থাকে, সংক্রামণের ভয়ে কেউ সৎকারে এগিয়ে আসে না। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ইরানে গণকবর হচ্ছে। প্রিয়জনের মৃত্যুতে জানাজা, শ্রাদ্ধ কিংবা ফিউনারেল হচ্ছে না। হারানো স্বজনের বিদায় ক্ষনে তার প্রাপ্য সম্মান এবং ভালোবাসাটুকু দিতে না পারার এই কষ্ট কি প্রিয়জন হারানোর কষ্টের চেয়েও বেশি করে বাজে? তবে কান পেতে যদি শুনি হয়তো মৃত স্বজনরা আমাদের বলছে -
"আমি আছি , আমি ভালো আছি। আমিতো সৃষ্টিকর্তার আমানত ছিলাম, সৃষ্টিকর্তার কাছেই ফিরে এসেছি। আমার শরীরে ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছিল তাই ওই শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে হলো, কিন্তু আমিতো আছি। আত্মার কি মৃত্যু আছে? তোমরা যখন আমার ভাইরাস আক্রান্ত শরীরটার চিকিৎসার জন্য ছুটোছুটি করছিলে আমি প্রানপনে বলতে চেয়েছি তোমরা দূরে থাকো, নিরাপদে থাকো। আমি চাইনি আমার শরীরের ভাইরাস তোমাদের কাউকে স্পর্শ করুক। তোমরা আমায় যেমন ভালোবাসো, আমিওতো তোমাদের তেমনি ভালোবাসি। এইযে আমার মৃত শরীরটার সৎকারের জন্য ছুটোছুটি করছো, আমি ভয় পাচ্ছি, এই শরীর থেকে ভাইরাস যেন তোমাদের কাউকে সংক্রামিত না করে। যত তাড়াতাড়ি পারো এই শরীরকে তোমরা মাটি চাপা দাও কিংবা পুড়িয়ে ফেলো। আমিতো আর ওই শরীরে নেই। আমি এখন আত্মা। আমার জন্য প্রার্থনা - সে তো তোমরা চোখ বন্ধ করে যেকোনো সময় করতে পারো। আমি আছি। আমি থাকবো। আত্মার কি মৃত্যু হয়!"
এই মহামারীতে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাঁদের জন্য গভীর ভালোবাসা আর সহমর্মিতায় আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট খুঁজে দেখেছি কোভিড-১৯ এ মৃতদেহ সৎকারের উপর কোনো গাইডলাইনস আছে কিনা। মার্চ ২৪, ২০২০ এ তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। এখানে আমি তার থেকে কিছু অংশ সংকলিত করেছি। যেহেতু এই ভাইরাসটির উপর এখনো গবেষণা চলছে, কিছু বিষয় এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। নতুন তথ্যের ভিত্তিতে এই গাইডলাইনের পরিবর্তন ও পরিমার্জন হতে পারে।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু যদি হাসপাতালে হয় তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নীতিমালা অনুযায়ী লাশ হস্তান্তরের আগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি কোনো কারণে মৃতদেহের অটোপ্সি করতে হয় সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি যথাযথ সতর্কতা নিয়ে এবং প্রয়োজনীয় পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পরেই কাজ করবেন। তবে কেউ যদি বাড়িতে মৃত্যুবরণ করে এবং মৃত্যুর সম্ভাব্য বা নিশ্চিত কারণ কোভিড-১৯ হয় সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কি কি সতর্কতা অনুসরণ করা উচিত তা-ই আমি এখানে সংকলন করেছি।
মহামারীতে মৃত ব্যক্তির দেহ কোনো কারণেই সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা উচিত নয়। যত তাড়াতাড়ি সৎকার করা সম্ভব ততই ভালো। আবার বাড়াবাড়ি রকমের তাড়াহুড়ো করে নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু করারও প্রয়োজন নেই। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তির মৃতদেহ সামাজিক এবং ধর্মীয় মতে মাটি চাপা দিয়ে অথবা পুড়িয়ে সৎকার করা যেতে পারে। কলেরা কিংম্বা ইবোলার মতো কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তির মৃতদেহ ততটা সংক্রামক নয়। তবে মৃতদেহের ফুসফুসে এবং ইন্টারনাল ফ্লুইডে ভাইরাসটি দীর্ঘ সময় সক্রিয় থাকতে পারে। মৃতদেহে ক্যাথেটার, স্যালাইন টিউব বা অন্য কোনো প্রকারের টিউব থাকলে তা সরিয়ে যথাযথ ভাবে ডিসপোজ করুন। যদি মৃতদেহের ইন্টারনাল ফ্লুইড কোনোভাবে নিঃসৃত হওয়ার অথবা দেহের বাইরে ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে তাহলে মৃতদেহ সৎকারের জন্য প্রস্তুতির সময় (গোসল দেয়া, নখ কাটা, সেভ করা এবং চুল পরিপাটি করার সময়) যারা মৃতদেহের সংস্পর্শে আসবে তাদের গ্লাভস, ইম্পারমিয়েবল এবং ডিস্পোসেবল গাউন বা এপ্রোন, মেডিক্যাল মাস্ক, আইগ্লাস, ফেইসশিল্ড এবং বুট সহ সম্পূর্ণ পিপিই পড়তে হতে পারে। ডিস্পোসেবল গাউন না থাকলে কাজ শেষে পরনের কাপড় সাথে সাথে খুলে ধুয়ে ফেলতে হবে। মৃতদেহ প্রস্তুতির কাজ শেষ করে পিপিই খুলে সাথে সাথে ভালো ভাবে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। একাজে যত কম মানুষ নিযুক্ত হয় ততই নিরাপদ। পরিবারে শিশু, ষাটোর্ধ বয়স্ক, অথবা অসুস্থ কেউ থাকলে তাদের মৃতদেহ থেকে দূরে রাখুন। সৎকারের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলে পরিবারের সদস্য বা আত্মীয় স্বজনরা কমপক্ষে এক মিটার দূর থেকে মৃতদেহ দেখতে পারেন তবে স্পর্শ করা বা কপালে চুম্বন করা থেকে বিরত থাকুন। সবসময় নিজেদের মধ্যেও কমপক্ষে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন। মৃতদেহ বা চারপাশের কোনোকিছু স্পর্শ না করলেও দেখা শেষে সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলুন।
মৃতদেহ পরিবহনের জন্য বিশেষ যানবাহন বা ব্যাগ ব্যবহার আবশ্যক নয়। নিয়মমতো কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নিন। তবে যদি দেহথেকে কোনো ধরণের তরল নির্গমন হয় সেক্ষেত্রে ব্যাগ ব্যবহার করা অবস্যই প্রয়োজন। মৃত্যুর পর থেকে সৎকার পর্যন্ত দেহকে স্পর্শ করা বা স্থানান্তর করা যতটা সম্ভব সীমিত রাখুন। যারা মৃতদেহ চুল্লিতে বা কবরে নামাবেন তাদের জন্য গ্লাভস পরা আবশ্যক এবং কাজ শেষে গ্লাভস খুলে সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া অবস্যই প্রয়োজন। মৃতদেহ সময়মতো সমাধিস্থ করাটা জরুরি তবে অনেক লোক সমাগম করে জানাজা, শ্রাদ্ধ বা ফিউনারেল অনুষ্ঠান মহামারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখুন।
মৃত ব্যক্তির ঘর, আসবাব, ব্যবহার্য সামগ্রী, কাপড়, এসবের কিছুই পুড়িয়ে ফেলার প্রয়োজন নেই। এগুলো প্রথমে ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করুন এবং এরপর ৭০% ইথানল বা ০.১% ব্লিচ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিন। এই উপায়ে সম্ভাব্য সকল সংক্রামিত জায়গাও জীবাণুমুক্ত করে নিতে পারেন। মৃতের পোশাক এবং অন্যান্য ব্যবহার্য কাপড় সম্ভব হলে মেশিনে ৬০ -৯০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপে ধুয়ে নিন। মেশিন না থাকলে কোনো বড় পাত্রে সাবান এবং গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এরপর সাবান পানি ফেলে দিয়ে ০.০৫% ক্লোরিনে আধঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিন। হাতে কাপড় ধোয়ার সময় কাঠি দিয়ে নাড়ুন এবং ময়লা পানি যেন ছিটিয়ে চোখে মুখে না পরে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিন।
পরিশিষ্ট: আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গাইডলাইন অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। সম্ভব হলে আপনি আপনার বিবেচনা অনুসারে আরো বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করুন।
ছবি: সংগৃহিত
Comments